সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আম্ফানের ১২তম দিনেও আশাশুনির দুই ইউনিয়নে ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী    

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ১২ তম দিনেও  পানিবন্দী থেকে মুক্তি মেলেনি আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শীউলা ইউনিয়নের ৬০ হাজার মানুষের। জোয়ারে পানি কিছুটা কমলেও সহসায় মুক্তি মিলছে না তাদের। 

গত ২০ মে সাতক্ষীরা জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুই ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ১৯টি স্থান ভেঙে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ২০ হাজার চিংড়িঘের ও পুকুর। নদীর জোয়ার  ভাটার তালে চলছে তাদের জীবন। প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, এই ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৫৫ জন। ইউনিয়নটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘেরা। আম্ফানের আঘাতে কুড়িকাউনিয়া চারটি, চাকলা একটি ও হরিশখালির তিনটি স্থানসহ ১৩টি স্থান ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এসব স্থান দিয়ে নদীর লোনা পানি ঢুকে ইউনিয়নের চাকলা, রুইয়ের বিল, সুভদ্রকাটি, শ্রীপুর, কুড়িকাউনিয়া, প্রতাপনগর, মাদারবাড়ি, কল্যাণপুর, সনাতনকাটি, হিজলেকোলা, হরিশখালিসহ ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৭ হাজার পরিবারের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকেই গৃহহীন হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। ভেসে গেছে আট হাজার চিংড়িঘের। জোয়ার-ভাটার মধ্যে বাঁধা পড়েছে এ ইউনিয়নের মানুষের জীবন। ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে কয়েক হাজার প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। এদিকে বাঁধ, দড়ি ও স্বেচ্ছাশ্রমিকদের খাওয়ার ব্যবস্থার বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করছে না। গত ১২ দিন ধরে স্থানীয়রা স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ মেরামত করে যাচ্ছে। মেরামতকৃত বেড়িবাধ আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে।  চাকলা গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ আকবর আলী বলেন, আমাদের বাড়ি ঘর সব পানির তলে। সারাদিন বাঁধ মেরামত করি রাতে আবার তা ভেঙ্গে যায়। প্রতি দিন কি এভাবে বাধ মেরামত করা যায়। বাড়িতেও আমাগো খাবার নেই। কাজ নেই। কি করবো,চলতেও পারিনা। কানে শুনতেও পারি না। একবেলা করে খেয়ে পরে আসি। কি করবো । প্রধান মন্ত্রীর কাছে একটায় দাবী না খেয়ে থাকতে পারবো কিন্তু ঘর না থাকলে থাকবো কোথায়।  একই এলাকার শাহিদা জানান, আমাগো ত্রাণের চেয়ে টেকসই বাঁধ কুরে দেওয়ার ব্যবস্থা কুরে দিতে কও। এমন কুরে বছর বছর বাঁধ ভাঙে ঢুবিয়ে সব শেষ কুরে দেবে তা সহ্য কুরা যায় না। জোয়ার-ভাটায় বাধা পুড়ে আমাকে জীবন।’এক দিনের ব্যবধানে তার মত অনেকেই এখন এখন নিঃস্ব।

১নং ওয়ার্ডের আবু মুসা মিস্ত্রির ছেলে মনিরুজ্জামান জানান, তাঁর বাড়িতে পানি ঢুকেছে। আম্পানে তাঁর সব শেষ হয়ে গেছে। এখন কাজ কাম কিছই নেই। ব্যবসা ও নেই। ঘের শেষ। 

উপজেলার শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল জানান, উত্তর দিক ছাড়া তিন দিকে নদীবেষ্টিত তাঁর ইউনিয়ন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘেরা এ ইউনিয়নে ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। আম্ফানে বাঁধের ছয়টি স্থান ভেঙে ২১টি গ্রাম প্লবিত হয়েছে। ২২ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে থাকায় নৌকায় চলাচল করে মানুষ। হাজরাখালি গ্রামের ইশারাত, আফসার, জাহাঙ্গীর হোসেন, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় আছেন। কয়েকজন বলেন, আম্পানের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাদের সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি পড়ে গেছে। চিংড়িঘের ভেসে গেছে। করোনার মধ্যে কাজ করার সুযোগ নেই।

কালিমাখালি গ্রামের কামাল হোসেন ১৫০ বিঘা ও আবদুল মান্নান ২০০ বিঘার ঘেরে চিংড়ি চাষ করেন। তাঁরা জানান, দুজনেরই ওই জমিতে চিংড়ি চাষ করতে কোটি টাকার ওপর খরচ হয়েছে। মহাজন ও ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। চিংড়ি উঠতে শুরু হওয়ায় সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু আম্পানে ঘের ভেসে যাওয়ায় পথে বসেছেন তাঁরা।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নাহিদুল ইসলাম জানান, সার্বিক বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রি, সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছেন। প্রতাপনগর ও শ্রীউলার বড় বড় ভাঙন ( ক্লোজার) বাঁধার জন্য সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। ছোট ছোট ভাঙন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতাপনগর এলাকায় ভাঙনরোধে ৩০ হাজার প্লাস্টিকের ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে বেড়ি বাঁধ মেরামত ও নির্মাণ করা সম্ভব হবে।   

এদিকে শনিবার দুপুরে আশাশুনিতে শ্রীউলা ইউনয়নের হাজরাখালী পয়েন্টে ঘুর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত  বেঁড়িবাধ সংস্কাররের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী।  বালুর বস্তা, গাছের বল্লী ও বাশ দিয়ে ভাঙনকবলিত বেড়িবাঁধ সংস্কারের এই কাজে নেতৃত্বে দিচ্ছেন লে. কর্নেল আনোয়ার ও লে. কর্নেল ফারহান মনির।

মেজর তাজদিক জানান, সাতক্ষীরা ও খুলনার ভাঙনকবলিত ১৩টি পয়েন্টে বেড়িবাধ সংস্কারের কাজ করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এর মধ্যে সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের ১১টি এবং খুলনার কয়রার ২টি পয়েন্টে কাজ করবে সেনাবাহিনী।

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বেঁড়িবাধ ভেঙে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। তাদের এ অবস্থা থেকে দ্রুত পরিত্রান ও টেকসই বেঁড়িবাধ সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর উপর দায়িত্ব অর্পন করেছেন। জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং পাউবোকে সমন্বয় করে প্রতিটি পয়েন্টের বেড়িবাঁধ তারা সংস্কার করবে। এদিকে, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বেঁড়িবাধ সংস্কারের কাজ শুরু করায় উপকূলীয় এলাকার মানুষ কৃতজ্ঞতা সাধুবাদ জানিয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ